মানুষ কিভাবে কঠোর পরিশ্রমী হয়ে উঠে ?

 সাধারন অর্থে পরিশ্রম বলতে কয়িক শ্রম বা শারিরীক পরিশ্রমকেই বুঝি।প্রশ্ন হল মানুষ কেন পরিশ্রম করে ?

মানুষ কিভাবে কঠোর পরিশ্রমী হয়ে উঠে ?


সাধারনতঃ দেখা যায় মানুষ ২ ( দুই ) কারণে পরিশ্রম করে।

১ম কারণ ঃ

আমরা বাঙালীরা জাতিগত ভাবেই অলস। এদেশের মাটি , প্রকৃতি ও পরিবেশ আমাদের অলসতার জন্য অনেকটাই ভূমিকা রাখে। 

কিন্তু ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। যখন ঘরে খাবার থাকেনা , তখন পরিশ্রম না করে উপায় আছে ? অতএব পরিশ্রমের ১ম কারণটি হল অভাব দূর করা। যারা লেখাপড়া করতে পারে না, তারা দিন-মজুরের কাজ করে। আর বাকীরা লেখাপড়া করে একটু ভিন্ন পরিবেশে তাদের শ্রম বিক্রি করে। উভয়ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য কিন্তু অভাব থেকে মুক্তি পাওয়া।



সাধারনতঃ এধরনের পরিশ্রম হয়ে থাকে ইচ্ছার বিরূদ্ধে। নির্ধারিত সময় পরিশ্রম করার পর মানুষের আর পরিশ্রম করার অনুপ্রেরণা কাজ করে না।

২য় কারণঃ

মানুষ পরিশ্রমী হয়ে উঠার ২য় কারণটি হল স্বপ্নপূরণ। এক্ষেত্রে মানুষ স্বেচ্ছায়, স্বপ্রনোদিত হয়ে পরিশ্রম করে থাকে। এক্ষেত্রে মানুষের ভিতর থেকে অনুপ্রেরণা তৈরী হয়। ফলে স্বপ্ন পূরণের পরিশ্রমের কোন সীমারেখা থাকেনা।



এক্ষেত্রে আমেরিকার বিখ্যাত দুই ভাই অরভিল এবং উইলভার রাইট এর নাম উল্লেখযোগ্য। ছোটবেলায় তাদের বাবা তাদেরকে প্রোপেলার বা চরকি বানিয়ে দিতেন এবং সেটা নিয়ে দুই ভাই বাতাসে দৌড় দিতেন এবং আনন্দ উপভোগ করতেন। মজার ব্যাপার হলো এই চরকি ঘুরানো থেকে তাদের মাথায় একটি স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল সেটি হল এই চরকি ঘুরিয়ে কিভাবে আকাশে উড়া যায়।

বাবা মারা যাওয়ার পরে দুই ভাই সংবাদপত্র বিক্রি করে  জীবিকা নির্বাহ করতে থাকলেন। কিন্তু মাথায় ছিল আকাশে উড়ার স্বপ্ন। এজন্য তারা টাকা উপার্জনের দিকে মনোযোগ দিলেন। দুই ভাই রাস্তার পাশে বসে সাইকেল মেরামত করার কাজ শুরু করলেন। একসময় তারা পাকা মিস্ত্রি হলেন এবং বাজার থেকে যন্ত্রাংশ কিনে নতুন সাইকেল বানানো শুরু করলেন। বাজারে তাদের সাইকেলের খুব চাহিদা তৈরি হয়েছিল। এক সময় তারা সাইকেলে ইন্ডাস্ট্রি করে অনেক টাকার মালিক হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে তারা সারা বিশ্ব থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে থাকলেন এবং সর্বশেষ ইঞ্জিন আবিষ্কার কে কেন্দ্র করে তারা আরো উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। ইঞ্জিনকে আরো শক্তিশালী করে তারা এক সময় আকাশে ওড়ার একটি নকশা তৈরি করে সত্যি সত্যি এক সময় আমেরিকার কিটি হক স্টেডিয়ামে সমবেত জনতার সামনে আকাশে উড়ে চমক সৃষ্টি করেছিলেন।

এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, তারা সাইকেল তৈরি করার যে গ্যারেজটি তৈরি করেছিলেন,  সেখানে আশেপাশের লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল,  কারণ অনেক সময় তারা সারারাত কাজ করতেন। তাদের এই লোহা লক্কর এর ঠুনঠান শব্দের কারণে প্রতিবেশীরা তাদেরকে অনেক গালমন্দও করতেন।

কিন্তু তারা তাদের স্বপ্ন থেকে পিছু হটেননি। তাহলে দেখুন স্বপ্ন মানুষকে অসম্ভব পরিশ্রমী করে তুলে যার প্রেরণা মানুষের ভিতর থেকে তৈরি হয়।

এত গেলো স্বপ্নের কথা। জীবনে সফল হওয়ার জন্য স্বপ্ন কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে,  আমরা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারছি।

এখন মানুষ যদি স্বপ্নই দেখতে না পারে তাহলে সফলতার চূড়ান্ত পরিশ্রম কি কখনো করা সম্ভব? নিশ্চয়ই না।মানুষ কখনোই স্বপ্ন দেখতে পারবেনা যদি তার নেতিবাচক মনোভাব ভিতরে লালিত হয়। এই পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ রয়েছে।

১। Optimist বা আশাবাদী : আশাবাদী মানুষেরাই কেবল স্বপ্ন দেখতে পারে। একজন ছাত্রের কথাই ভাবুন, যিনি প্রচন্ড আশাবাদী, যে কারণে তিনি গোল্ডেন এ+ পাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।

২। Pessimist বা নৈরাশ্যবাদী: একজন নৈরাশ্যবাদী মানুষ কখনোই স্বপ্ন দেখতে পারে না। যিনি আগে থেকেই জানেন যে,  যত লেখাপড়াই করি না কেন পাস করা আমার দ্বারা সম্ভব না, উনি কি কখনো গোল্ডেন এ+ পাওয়ার স্বপ্ন দেখবে?

মাদার তেরেসা বলেন, if you judge people, you will not love them. অর্থাৎ মানুষের ভালো-মন্দ যাচাই করতে গেলে কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়।

অন্তরে ভালোবাসা তখনই তৈরি হয় যখন আমরা কারো ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করি।

 আশাবাদী ও নৈরাশ্যবাদী পার্থক্যঃ

একজন নেতিবাচক মানুষকে ফুলের বাগানে নিয়ে গেলেও তিনি বাগান দেখে বলতে পারেন, বাগানটি সুন্দর কিন্তু কোণার মধ্যে গোবর রেখে দেওয়া আছে। উনি ফুল দেখতে পান না, বরং গোবর দেখেন।

অপরদিকে একজন  ইতিবাচক মানুষ কে মরুভূমিতে নিয়ে গেলেও তিনি বলতে পারেন, বাহ! ধু ধু মরুভূমিতে দুই একটা খেজুর গাছ কি চমৎকার লাগছে। উনি মরুভূমি দেখে না বরং খেজুর বাগান দেখে।

একজন নেতিবাচক মানুষ পচা ডুবা দেখেন। কিন্তু একজন ইতিবাচক মানুষ সেখানে ১৩ তলা বিল্ডিং এর স্বপ্ন দেখেন।

বিশ্ব যুদ্ধের সময়কার ইংল্যান্ড এর প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেন, "The pessimist sees difficulty in every opportunity . But the optimist sees the opportunity in everyday difficulty."

তাহলে বুঝা গেল সফলতার মূলে রয়েছে পরিশ্রম । আর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরিশ্রমের জন্য দরকার হল  স্বপ্ন দেখা। আর এই স্বপ্ন দেখার জন্য প্রয়োজন  ইতিবাচক চিন্তা ভাবনা বা ইতিবাচক মনোভাব।

এবিষয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভাবনা উল্লেখযোগ্যঃ

ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট A P J Abul Kalam Azad বলেন,

  All birds find shelter during the rain. But Eagle avoids rain by flying above the clouds. Problems are common but attitude makes the difference.

অর্থাৎ বৃষ্টির সময় সব পাখি আশ্রয় খুঁজে। কিন্তু ঈগল বৃষ্টি উপেক্ষা করে মেঘের উপর দিয়ে উড়ে বেড়ায়। সবার সমষ্যা একই হলেও দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভাব সেখানে ভিন্নতা এনে দেয়।



আমেরিকার বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমস বলেন, মানুষ মনোভাব পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের জীবন পরিবর্তন করতে পারে।

চলুন দেখা যাক,  নেতিবাচক মনোভাব মানুষকে কিভাবে ধ্বংস করে।

হতাশাগ্রস্থ জীবন:

নেতিবাচক চিন্তাভাবনার ফলে মানুষের জীবন উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে । অনেক সময় কিছুই ভালো লাগেনা। সব সময় চিন্তা হয়,  তার দ্বারা কিছু হবে না। তার ভাগ্যই খারাপ। ফলে জীবনে সফল হওয়ার জন্য কোন লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করাও তার দ্বারা সম্ভব হয় না।
জীবনে ব্যর্থতার গ্লানি সহ্য করতে না পেরে অনেকেই মাদকাসক্তির পথ বেছে নেয়। তাদের বন্ধুবান্ধব বা সামাজিক সম্পর্ক বলতে কিছুই থাকেনা। বিয়ে-শাদী করে সুন্দর পরিবার গঠনও  তাদের দ্বারা সম্ভব হয় না।অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেক সময় এই ব্যর্থ লোকেরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

অসুখী পরিবার:

এই সমস্ত নেতিবাচক মানুষের পারিবারিক জীবন অশান্তিতে ভরে যায়। স্বামী স্ত্রী দুজনেই একে অপরের দোষ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নেতিবাচক চিন্তার কারণে কারো ভালো কাজের প্রশংসা করা তাদের দ্বারা সম্ভব হয় না।

সম্পর্কের তিক্ততা এতই চরম আকার ধারণ করে মে, তারা আর স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে না। প্রতিনিয়ত ঝগড়াঝাটি করে শেষ পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয়।

অপ্রিয় ব্যক্তিত্ব: 

নেতিবাচক চিন্তাভাবনার কারণে মার্জিত পোশাক আশাক এর প্রতি তাদের রুচিবোধ তৈরি হয় না। যেমন খোঁচা খোঁচা দাড়ি , লম্বা লম্বা চুল , অবাঞ্ছিত পোশাক , এমন কি ঠিকমতো দাঁত ও ব্রাশ করেনা। ফলে এমন একটি অপ্রিয় ব্যক্তিত্ব তৈরি হয় যে, এর ফলে বন্ধু-বান্ধব ও সামাজিক সম্পর্ক একেবারে শূন্য হয়ে যায়। এতে করে দিনে দিনে তার হতাশা আরও বাড়তে থাকে।

উদ্দেশ্যহীন জীবন:

এই শ্রেণীর মানুষের জীবন উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে। জীবনে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং কর্মনীতি তৈরি হয় না। ফলে অন্যরা যখন দিবারাত্রি পরিশ্রম করে সফলতার পথ বেছে নেয়,  তখন সে হয়তো রুমের বাতি নিভিয়ে বিচ্ছেদের গান শুনে। 
বলা হয়, " An idle brain is the devils workshop. অর্থাৎ অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। কোন কাজকর্ম না থাকার কারণে এ সকল লোক দ্বারা যাবতীয় অপকর্ম সংগঠিত হয়। ইভটিজিং থেকে শুরু করে, চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে সামাজিকভাবে অন্ধকার জগতের নানা কাজকর্মের  সাথে জড়িত থেকে এই সমস্ত লোকেরা  সমাজকে দূষিত করে।

এবার দেখা যাক ইতিবাচক চিন্তার ফলাফল কি হতে পারেঃ

দুশ্চিন্তাহীন চাপমুক্ত জীবনঃ 

আশাবাদী লোকেরা যেহেতু সব সময় ইতিবাচক চিন্তা করেন,  তাদের জীবন হাসিখুশি আনন্দময়। কারণ তারা তাদের সফলতার ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত থাকে। তাদের কোন টেনশন থাকে না। তাদের মধ্যে থাকে না কোন হারানোর বেদনা বা না পাওয়ার বেদনা। তারা সর্বদা যে কোন ঘটনা মেনে নেওয়ার জন্য তৈরি থাকেন।

মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা সাধারনতঃ না পাওয়ার বেদনা বা কোন কিছু হারিয়ে যাওয়ার বেদনা থেকে তৈরী হয়। আমাদের প্রত্যেকের মনোজগতে প্রতিনিয়ত দুইটি অনুভূতি বিরাজমান থাকে। একটি হল সুখানুভূতি আর অন্যটি হল দুখানুভূতি।

ইতিবাচক মানুষেরা দেখা যায় ডাল-ভাত খেয়ে মহা আনন্দে দিন কাটায় , আবার নেতিবাচক লোকেরা দেখা যায় পোলাও মাংস খেয়েও সুখী হতে পারে না।


সুখী -সুন্দর পরিবারঃ 

যারা ইতিবাচক চিন্তার অধিকারী , সেই সকল পরিবারের যেকোনো ঘটনা সহজ ভাবে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মেনে নেয়। কারণ তারা জানে মানুষ মাত্রই ভুল ত্রূটি হতে পারে। খামাখাই একজন আরেকজনের ভুল ধরে মধুর রাত্রি গুলি নষ্ট করার তারা পক্ষপাতি নয়। তারা একে অপরের ভালো জিনিস গুলো চর্চা করে। ফলে তাদের দাম্পত্য জীবন হয় মধুময়।

বন্ধুলাভ ও সুন্দর সামাজিক সম্পর্কঃ 

ইতিবাচক মানুষগুলো চাপমুক্ত থাকার কারণে সদা হাস্যজ্জল। তাদের কাছে যে কোন মানুষ এসে আশার বাণী শুনে। ফলে তারা অতি সহজেই প্রচুর বন্ধুবান্ধব এর সান্নিধ্য লাভ করে। এতে করে একটি সুমধুর সামাজিক সম্পর্ক তৈরি হয়।

সুস্বাস্থ্যের অধিকারীঃ 

ইতিবাচক মানুষেরা যেহেতু কোনো দুশ্চিন্তা করে না । কারো ব্যাপারে কোন খারাপ চিন্তা ভাবনা করে না, তারা এমনিতেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। কারণ প্রবাদ আছে , সুস্থ দেহে সুস্থ মনের বিকাশ।

উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিঃ 

যে প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং কর্মচারী মিলে একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি হয়, সেখানে মালিক তার কর্মচারীদের কে সর্বদা আশার বাণী শোনায়,  সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়,  যে কারণে কর্মীরা উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করে। ফলে উৎপাদনশীলতা বেড়ে যায়।

সন্মান বৃদ্ধি পায়ঃ 

ইতিবাচক মানুষেরা তাদের সুন্দর একটি সামাজিক সম্পর্কের কারণে মানুষের মধ্যে চমৎকার একটি গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পারে। অন্য মানুষেরা তাদের কাছে এসে আশার বাণী শুনে, জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। যে কারণে সকল মানুষ তাদেরকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখে।

বড় বড় স্বপ্ন তৈরী হয়ঃ 

যারা ইতিবাচক চিন্তাভাবনার অধিকারী তারা অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখতে পারে। পৃথিবীতে যত বড় বড় স্থাপনা তৈরি হয়েছে, এইসব গুলোই  ইতিবাচক চিন্তাভাবনার মানুষের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। যেমন আগ্রার তাজমহল। ২০ হাজার লোক বাইশ বছর কাজ করে এই স্থাপনাটি তৈরি করেছিল। আমরা ভাবতেই পারি না এত বড় স্বপ্ন কিভাবে মানুষ দেখতে পারে। এরকম স্বপ্নবাজ মানুষের দ্বারাই আসলে এই পৃথিবী সমৃদ্ধ হয়েছে।

এ বিষয়ে আলবার্ট আইনস্টাইনের বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেন আমাদের জ্ঞানের চেয়ে পাওয়ারফুল বা শক্তিশালী হচ্ছে আমাদের কল্পনা শক্তি।


ইতিবাচক চিন্তাভাবনার ব্যাপারে আরো কথা বলেছেন আমেরিকার বিখ্যাত লেখক নেপোলিয়ন হিল। তিনি বলেন, আপনি সেটাই, আপনি যা ভাবেন।

উপরোক্ত আলোচনায় বুঝা গেল,  পরিশ্রমের মূলে হচ্ছে স্বপ্ন ।আর স্বপ্ন তারাই দেখতে পারে যাদের কল্পনাশক্তি ইতিবাচক এবং যাদের চিন্তাভাবনা ইতিবাচক।
তাহলে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরিশ্রম মানুষের সফলতার মূল চাবিকাঠি। আর ইতিবাচক চিন্তাই হচ্ছে স্বপ্ন দেখার হাতিয়ার। 
তাই আমাদের সকলের উচিত কিভাবে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা গড়ে তোলা যায়। এর জন্য করণীয় গুলো উল্লেখ করা হলো।

১। আত্মবিশ্বাস:

একজন নেতিবাচক মানুষ যদি নিজেকে ইতিবাচক মানুষে হিসাবে গড়ে তুলতে চায়,  তাহলে তার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে।
সূত্র: If someone can do it , I can do it.
তাকে চিন্তা করতে হবে, কেউ যদি কোন কাজ করতে পারে , তাহলে আমিও পারবো।

২। ইতিবাচক চর্চা করা:

কিছু বিষয়ে নিয়মিত চর্চার মধ্যে যদি নিয়ে আসা যায় , তাহলে আশা করা যায় একটা মানুষ ধীরে ধীরে ইতিবাচক হয়ে উঠবে। সেগুলো হল:
Think positive, 
সর্বদা ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে। চিন্তাটা যদি হয় বাবুই পাখির মত, তাহলে কিন্তু হবে না।বাবুই পাখি পা আকাশের দিকে রেখে তার বাসায় ঘুমায়। কেন এমন টি করে ? তার চিন্তাটা হল,  যদি আকাশ ভেঙে পড়ে তাহলে পা দিয়ে ঠেকাতে হবে।

Talk positive:

ইতিবাচক  কথা বলতে হবে। কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কেমন আছেন? উনি যদি ইতিবাচক হন তাহলে তো উনি বলবেন আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। এখন উনি তো এটাও বলতে পারে, খারাপ না। তাহলে কি ইতিবাচক চর্চা হবে?

 and Work positive: 

ইতিবাচক কাজ করতে হবে। দেখা গেল বাগানের পাশে লেখা আছে যে , এখানে ফুল ছেঁড়া নিষেধ। এটা দেখার পরে কেউ যদি গাছটি তুলে নিয়ে যায়, তাহলে উনি তো আর ফুল ছিঁড়েন নাই। তাই না?
এখন আপনারাই বলুন , এটা কি  ইতিবাচক কাজ হল?

৩। বড় চিন্তা করা:

কেউ যদি নিজেকে ইতিবাচক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চায় তার উচিত বড় বড় চিন্তা শুরু করে দেওয়া। কিছু তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করলেই এ বিষয়ে চর্চা শুরু হতে পারে। তবে বড় চিন্তা করার ক্ষেত্রে কিছু জটিল প্রক্রিয়াও রয়েছে।
ধরুন কারো জন্য কুঁড়েঘরে। তার ক্ষেত্রে বড় চিন্তা হবে একটি টিনের ঘর। আবার কারো জন্য যদি হয় টিনের ঘরে, তার  হয়তো বড় চিন্তা হবে একটি  পাকা বাড়ি। আবার যার পাকা বাড়িতে জন্ম তার হয়তো একটি টাওয়ার করার চিন্তা তৈরি হতে পারে।

৪। বই পড়ার অভ্যাস করা:

অনবরত পড়ার মধ্যে থাকলে মানুষের চিন্তা ভাবনা এমনিতেই ইতিবাচক হয়ে যায়। পৃথিবীর সবকিছু নেতিবাচক হতে পারে কিন্তু আপনার বইটি সর্বদা ইতিবাচক।
আমি ব্যক্তিগতভাবে দুইটি বই পড়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকি। একটি বইয়ের নাম হল উচ্চাকাঙ্ক্ষার ম্যাজিক। অপরটি হল তুমিও জিতবে। আমি নিশ্চিত, কেউ যদি এই দুইটি বই প্রতিদিন অল্প অল্প করে পড়তে থাকে, সে অবশ্যই ইতিবাচক মনোভাব অর্জন করতে পারবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

৫। আশাবাদী কাউকে অনুসরণ করা:

এটি জীবনের চরম বাস্তবতা। কেউ যদি কোন ব্যার্থ মানুষকে অনুসরণ করে সে তো ব্যর্থ হবেই।
নিজেকে ইতিবাচক বা আশাবাদী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে অবশ্যই কল্পনার জগতে এমন কাউকে আইডল হিসেবে গ্রহণ করতে হবে যিনি বারবার ব্যর্থ হয়েও আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এমন একজন ব্যক্তি হলেন আমেরিকার বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট জনাব আব্রাহাম লিংকন। উনার জীবনী পড়লে  যে কোন ব্যক্তি ইতিবাচক হতে বাধ্য।

৬। নেতিবাচক বিষয় পরিহার করা:

নেতিবাচক বিষয়গুলো যেমন হতাশা,  দুঃখ,  লজ্জা,  ভয়,  সন্দেহ,  ঈর্ষা, ইত্যাদি এমনকি এই সমস্ত বিষয়ে যারা লালন করে তারাও এই বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এই বিষয়গুলো অবশ্যই পরিহার করতে হবে। আমরা সোনা গহনা ইত্যাদি দামি জিনিসগুলো আলমারিতে যত্ন করে রাখি। আর খারাপ জিনিস গুলো ঘরবাড়ি ময়লা গুলো আমরা ডাস্টবিনে ফেলে দেই। ঠিক নেতিবাচক জিনিসগুলোকে এভাবেই পরিত্যাগ করতে হবে যদি সত্যিকার অর্থে কেউ প্রতিবাচক মনের মানুষ হতে চায়। ধরুন একটা গ্লাসে ময়লা পানি আছে। এই গ্লাসে যদি শরবত ঢালতে হয়, তাহলে অবশ্যই ময়লা সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করে তারপরেই এটাতে শরবত ঢালতে হয়। ঠিক নেতিবাচক জিনিসগুলোকেও এভাবে জীবন থেকে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।

৭। সর্বদা কাজে লেগে থাকা:

ইতিবাচক হওয়ার জন্য এটি একটি অত্যন্ত কার্যকরী পদক্ষেপ। বলা হয়, An idle brain is the devil's workshop. অর্থাৎ অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। যিনি সর্বদা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তার মাথায় কোন নেতিবাচক চিন্তা আসতে পারে না। যখনই কোন কাজ থাকে না, তখনই মাথায় আজেবাজে চিন্তা গুলো জেগে ওঠে। নানান কুচিন্তা এবং খারাপ কাজের প্রবণতা তৈরি হতে থাকে।

৮। অন্যকে দোষারোপ পরিহার করা:

অন্যকে দোষারোপ করা এটি মানুষকে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক করে। কিন্তু আমরা এই বিষয়ে সবাই খুব অগ্রসর। যেকোনো বিষয়ে ব্যর্থতার জন্য আমরা অন্যকে দায়ী করি। এটি এখনই বন্ধ করা উচিত।
ধরুন একই বেঞ্চে লেখাপড়া করে একটি ছাত্র গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলতেছে,  স্কুল ভালো , শিক্ষকরা ভালো, বাবা মা খুব ভালো দায়িত্ব পালন করেছেন ।এজন্য আমি ভালো করতে পেরেছি।
অপরদিকে যে ছেলেটি ফেল করেছে, সে বলতেছে স্কুল খারাপ , শিক্ষকরা খারাপ , বাবা মা কোন দায়িত্ব পালন করেনি, এজন্য আমি ফেল করেছি। এখন যেহেতু তার কোন দোষ নেই, এই জন্য লেখাপড়ার প্রতি তার মনোযোগ নাই।
অথচ ছেলেটি যদি কাউকে দোষ না দিতো, সে তখন ভাবতো যে একই বেঞ্চে লেখাপড়া করে সবাই খুব ভালো ভাবে পাশ করলো,  নিশ্চয়ই আমার মধ্যে কোন ত্রুটি আছে ।আমি নিজেকে সংশোধন করে আবার লেখাপড়া শুরু করবো।
তাহলে বুঝা গেল অন্যের উপর দোষ চাপালে নিজের জীবন ব্যর্থ হতে বাধ্য। আজই অন্যের উপর দোষ চাপানো পরিহার করে নিজেকে  ইতিবাচক চিন্তার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।

৯। ভুলে যাওয়া ও ক্ষমা করে দেওয়াঃ

এই ভুলে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু তাৎক্ষণিক ব্যাবস্থা নিতে পারলে কাজ হতে পারে।

প্রেমিকা হারিয়ে গেছে ? খুব দ্রুত আরেকটি নতুন সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে নিতে হবে।

এরকম হাজারো হারিয়ে যাওয়ার একটাই ফর্মূলা হল নতুন কিছু দিয়ে রিপ্লেস করা। এনড্রয়েড সেট ছিনতাই হয়ে গেছে ? দ্রুত একটি সেট কিনে ফেলতে হবে।

ক্ষমা করে দেওয়া কিন্তু সহজ কাজ নয়। দীর্ঘদিন মনের মধ্যে জিদ চেপে রাখলে ভিতর থেকে কখনো সৃজনশীলতা তৈরি হয় না।

এক লেখকের বাবা ছোট বেলায় তার মাকে সহ ফেলে রেখে চলে যায়। সে কোন অবস্থায় তার বাবাকে ক্ষমা করতে পারছিলো না। সে প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে বড় হচ্ছিল। তার খাওয়-দাওয়া , পড়ালেখা কেনকিছুতেই মনোযোগ ছিল না। একটাই চিন্তা , বড় হয়ে তার বাবাকে জিজ্ঞাস কেরবে সে কিভাবে তাকে ত্যাগ করতে পারল।

বড় হয়ে জানতে পারল , তার বাবা ঐ দেশের অন্য প্রদেশে থাকে। তখন সে ঐ প্রদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। যাত্রার পূর্বেই জানতে পারল তার বাবা মারা গেছে। তখন সে জিদ ধরল, বাবার কবরে থুথু মেরে আসবে।

নির্ধারিত দিনে সে ঐ প্রদেশে তার বাবার কবরের পাশে গিয়ে দেখে, কবরগাত্রে লেখা ছিল, Forgiveness is the fragrance of life. অর্থাৎ ক্ষমাই জীবনের সুঘ্রাণ।কথাটি পাঠ করার সাথে সাথে তার মনে ক্ষমা তৈরী হল, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি বের হল। মনে মনে ভাবল বাবা এভাবে চলে গেল অথচ দেখতেও পারলাম না বাবা কেমন ছিল। আরও অনেক কিছু। এই লোকটি যেদিন তার বাবাকে ক্ষমা করে দিল, সেদিন থেকে সে মানসিক চাপমুক্ত হয়েছিল। ক্ষমা করে দেওয়ার পরে তার কাছে এই পৃথিবী সুন্দর মনে হয়েছিল এবং তিনি লেখালেখি করে  বিখ্যাত হয়েছিলেন।

১০। ইতিবাচক চিন্তা দিয়ে দিবসের সূচনা:

এটি অত্যন্ত কার্যকরী পদ্ধতি। বিভিন্ন নিউজ বা সংবাদে ঘুম থেকে উঠেই দেখা গেল গাড়ি উল্টে মানুষ মারা গেছে,  আগুন লেগে বাড়ি ঘর পুড়ে গিয়েছে। এর চেয়ে ভালো টিভিতে টম এন্ড জেরি দেখে মনটাকে একটু ফ্রেশ করে কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাওয়া।

১১। অবাঞ্চিত পোশাক থেকে বিরত থাকা:

এটি পরীক্ষিত। মানুষ যখন নতুন জামা কাপড় পরিধান করে , তার মন উৎফুল্ল হয়ে যায় এবং তার ভিতরে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা কাজ করতে থাকে।

২। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা:

সত্যিকার অর্থে দেহে যদি সুখ না থাকে,  মনে কখনো সুখ আসবে না,  মনে কোন ইতিবাচক চিন্তাভাবনাও কাজ করবে না। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে, A sound mind , in a sound body.

১৩। সুন্দর ব্যক্তিত্ব অর্জন করা:

কেউ যদি একবার নিজেকে একটা সুন্দর ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাজে পরিচিত করতে পারে , তখন তার ভিতরে কোন নেতিবাচক চিন্তাভাবনা আর কাজ করতে পারে না। তখন সে হয়ে যায় সমাজ স্বীকৃত একজন ভালো মানুষ। চাইলেও সে কোন নেতিবাচক কাজকর্মের সাথে যুক্ত হতে পারেনা।

১৪। নির্ভরশীলতা পরিহার করা:

কেউ যদি অন্যের উপর নির্ভরশীলতা পরিহার করে নিজের দায়িত্ব নিজেই নিয়ে নিতে পারে,  তখন সে নতুন একটি মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়। তার ভিতরে তখন সৃজনশীলতা শতভাগ কাজ করতে থাকে। নিজেই নিজের জীবনের পরিকল্পনা তৈরি করে সামনে অগ্রসর হতে থাকে।

১৫। হাল ছেড়ে না দেওয়া:

যারা ইতিবাচক মানুষ তারা শেষ পর্যন্ত লড়াকু সৈনিক হিসেবে সামনে অগ্রসর হয়। বারবার পরাজিত হয়েও হাল ছাড়তে রাজি নয়। যেকোনো মূল্যে শেষ দেখে ছাড়বো,  এ ধরনের মনোভাবই সত্যিকার অর্থে ইতিবাচক মনোভাব। আর পরিনামে এই লোকেরাই সফলতা অর্জন করতে পারে।
এই আলোচনার মূলকথা হল, যাবতীয় নেতিবাচক বিষয় জীবন থেকে হঠিয়ে দিয়ে , ইতিবাচক চিন্তা এবং কর্ম লালন করতে পারলে বড় বড় স্বপ্ন তৈরী করা যাবে । আর এই স্বপ্নই মানুষকে কঠোর পরিশ্রমী করে গড়ে তুলে।










Post a Comment

0 Comments