ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ষাটের দশকে আমাদের এই বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। আমার মনে আছে সোয়াসের চাল তখন এক টাকায় বিক্রি হতো। এই এক টাকা দিয়ে সরিষার তেল, নুন, কেরোসিন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনে নিয়ে গৃহস্থরা বাসায় ফিরতে পারত।
প্রায়শতভাগ মানুষের পেশা ছিল কৃষি কাজ। অগ্রহায়ণে যখন ধান কাটা শেষ হয়ে যেত, শুরু হতো শীতকাল। এই সময়টাতে কৃষকেরা বাড়ির আশেপাশের জমিতে শীতকালের সবজি চাষ করত। মৌরি, ধইন্যা, কালোজিরা থেকে শুরু করে সবকিছুই তখন আবাদ হতো।
বাড়ির আঙ্গিনাগুলোতে সিম , লাউ ইত্যাদি সবজির চাষ হতো।
আলু , বেগুন, টমেটো ইত্যাদিতে তখন মাঠ ভরে যেত।
চাষ হতো ,পেঁয়াজ, রসুন, গাজর , শালগম আরো কত কি।
এছাড়া বাড়ি থেকে দূরের জমিগুলোতে খেসারি, মুশুরি ও মাশকলাই ইত্যাদি বুনে দেওয়া হতো। অনেক সময় আমন ধানের বিচালীর মধ্যে খেসারির গাছগুলো মানুষের কোমর পর্যন্ত উচু হতো। খেসারি, মুসুরি এবং মাসকলাইয়ের ফুল ফুটার সময় মাঠগুলো এক অপরূপ শোভা বর্ধন করত। এছাড়া মাঠের পর মাঠ সরিষার চাষ হতো। সারা মাঠ মনে হতো হলুদ গালিচা দ্বারা আবৃত হয়ে আছে।
পাড়ার ছেলেরা অনেক সময় দলবেঁধে খেসারি ক্ষেতে যখন ফল হতো তখন খেসারি গাছগুলো উপড়ে এনে আগুন ধরিয়ে দিত। ছড়া সহ খেসারি গুলো ছিড়ে ছিড়ে খেতে কত যে মজা ছিল সেটা এখন ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
অগ্রহায়ণ শেষে আরেকটি মাজার ব্যাপার ছিল আখ মাড়াই। বাড়ির আঙিনার জমিগুলোতে বসানো হতো লোহার মেশিন যেটা গরু দিয়ে ঘোরানো হতো। পাশেই বিশাল বিশাল চুলা তৈরি করা হতো এবং বড় বড় কড়াইয়ে আখের রস জাল দেওয়া হতো রাত বারোটা পর্যন্ত। রাতের বেলা আখের রস প্রথম বার যে জাল দেওয়া হতো এটাকে বলতো ছেও জাল।
দিনের বেলায় আখ কেটে খোসা ছড়িয়ে সেগুলো বিশাল স্তুপ করা হতো। সারা বিকাল থেকে শুরু হতো রাত দশটা পর্যন্ত চলতো আখ মাড়াই।
পরের দিন সকাল ৯ টা থেকে শুরু হতো গুড় তৈরির প্রক্রিয়া । সে কি আনন্দ। রাতের জাল করা রস কে পাকা জাল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের গুড় তৈরি করা হতো। আমাদের বাড়িতে কাঠের সাচ ছিল ।লোহার ডাবর থেকে একটি ছেনা দিয়ে টাপুর টুপুর এভাবে শব্দ করতে করতে সাচে ঢালা হত। এক ঘণ্টার মধ্যেই সেগুলো সাচ থেকে তুলে নেওয়া হতো ।গোল গোল সেই মিষ্টান্ন এর মত গুড়। এটাকে বলা হতো পারি গুড়। এই পাড়ি গুড় বাজারে নিয়ে বিক্রি করা হতো।
এছাড়া একটু কম গুণাগুণ সম্পন্ন গুড়কে বড় মটকার
মধ্যে ভরে সারা বছর খাওয়ার জন্য কৃষকরা সংরক্ষণ করতেন। আরেকটি মজার অভিজ্ঞতা ছিল গুড়ের মোচা তৈরি করা। রশিতে একটি সুপারি বেঁধে সেটিকে গুড়ের কড়াইয়ে ডুবিয়ে আবার উঠিয়ে নিতাম প্রথম দিন একটু বড় হতো । প্রতিদিন এভাবে করতে করতে পুরো সিজনে এটি একটি মোচার মতো আকৃতি তৈরি হতো এবং সেগুলো আমরা ঝুলিয়ে রাখতাম। যখন প্রয়োজন হতো এক একটি মোচা ভেঙ্গে আমরা ব্যবহার করতাম।
অপরদিকে ডুবা জমিতে শুরু হতো বুরো ধানের চাষ। ডুবা জমিগুলোতে বিলের ধারে ধারে তখন যে ধানগুলো চাষ হতো সেগুলো একটু মোটা ধরনের ধান ছিল ।যেমন বিল বাধাই একটা ধান ছিল সেটা অগ্রহায়নে হত এক ধরনের আমন ধান । যেহেতু এই ধান ডুবা জমিতে চাষ হতো এজন্য এর নিচের অংশ অনেক বড় হতো। অগ্রহায়ণে ধান কাটা শেষ হলে ওই জমিগুলোতে বিশাল ঘের তৈরি হতো । এইগুলা টেনে টেনে কৃষকরা জমি পরিষ্কার করে জমির চারপাশে এগুলো দিয়ে আইল তৈরি করত।
তখন কিছুটা পানি থাকতো এবং ওই জমিগুলোতে বোরো ধানের চারা রোপন করে দেওয়া হতো। ফাল্গুন চৈত্র মাসে এই বোরো ধানের ফলন হতো । তখন কিন্তু এই ধান ক্ষেতগুলো পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে যেত। তখন কৃষকরা এক ধরনের পানির কল দিয়ে বিল থেকে পানি সেচ করে এই বুরো ক্ষেতগুলোতে দিত। ময়মনসিংহে এই পানির কলটাকে বলা হতো কুন।
চৈত্র মাসের শেষের দিকে এই বুরোধানগুলো কাটা হতো। তবে প্রায় সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শিলাবৃষ্টিতে এই ধানগুলো নষ্ট হতো। কিন্তু এরপরেও এই বোরো ধান কৃষকদের আপৎকালীন ব্যায় নির্বাহের জন্য খুবই কাজে লাগতো।
শীতের পরে দখিনা হাওয়া বসন্তের আগমনী বার্তা দিয়ে যেত। ইতিমধ্যে কৃষকরা সরিষা, খেসারী, মুসুরি ও মাশকলাই সংগ্রহ করার পরে পুরো মাঠ ফাঁকা হয়ে যেত।
শুরু হতো ফাঁকা মাঠে ষাঁড়ের লড়াই। কোন এক গ্রামকে নির্দিষ্ট করে সব বাজারে ঢোল পিটিয়ে দেওয়া হতো । নির্ধারিত দিনে কৃষকেরা তাদের ষাড়গুলোকে কাগজের মালা পরিয়ে মিছিল করতে করতে লড়াই স্থলে হাজির হত। এলাকার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা লড়াই শেষে পুরস্কার বিতরণ করতেন।
এর মধ্যেই শুরু হয়ে যেত গ্রীষ্মকালীন ফসল বুনার প্রস্তুতি। দেশি লাঙ্গল এবং বলদ দিয়ে হাল চাষ করা ছিল কৃষকের একমাত্র ভরসা। তখন চলতো আউশ ধান ও পাট চাষের জন্য জমি প্রস্তুতি। বড় বড় ইটা গুলো রোদ্রে শুকিয়ে শক্ত হয়ে যেত। সেইগুলা মই দিয়ে এবং কাঠের মুগুর দিয়ে পিটিয় জমিকে সমান করা হতো । গোবর সংগ্রহ করার জায়গা থাকতো। সেখান থেকে গোবরগুলো তখন জমিতে ফেলা হতো। সার বা কীটনাশক কিছুই ব্যবহার করা হতো না।
ওই সময়টাতে কৃষকরা হালকা বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতেন। কিছু কিছু বৃষ্টি হলেই চৈত্র মাসের শেষের দিকে আউশ ধান এবং পাটের বীজ বপন করা হতো। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পুরো মাঠ সবুজে ছেয়ে যেত পাটক্ষেত এবং আউশ ধানে।
বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাসে এই আওশী ফসল এখন আর বাংলাদেশে চোখে পড়ে না। কি অদ্ভুত ধান ছিল। কটকতারা ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় কি সুন্দর ঘ্রান পাওয়া যেত। ধান ছিল লাল রঙের। এত মজার ভাত হত, তরকারি ছাড়াই এই ভাত খেয়ে ফেলা যেত। আরেকটি ধানের নাম ছিল আগালি ধান। এই ধানটি কোন এলাকায় নাম ছিল ছাওয়াইল্যা। কালো ধান গুলো ভেতরে লাল রংয়ের চাল হত। সেই আগালি দানের জাউ রান্না করে দেওয়া হতো। অদ্ভুত মজাদার সেই যাও খাওয়ার কথা আজও ভুলতে পারিনি।
ওদিকে পাট ক্ষেতের ব্যবহার ছিল বহুমুখী। পাট ক্ষেত পরিষ্কার করার জন্য ঘন পাট গাছগুলো উঠিয়ে ফেলা হতো। সেগুলো কৃষকরা শাক রান্না করে খেত। পাট গাছগুলো বড় হতে আর প্রতিনিয়ত পাট গাছের পাতা সংগ্রহ করা হতো পুরো সিজন ধরে।
আউশ ধান এবং পাট ক্ষেতের পরিচর্যা ছিল খুবই কষ্টকর। গ্রীষ্মকালীন প্রচন্ড গরম সহ্য করে কৃষকরা মাঠে কাজ করত। প্রায় সময় দেখা যেত ডাবা তামুক নিয়ে তারা মাঠে চলে যেত। কাজের ফাঁকে ফাঁকে হুক্কা টানতো। অদ্ভুত ছিল সেই গ্রাম্য জীবন।
মাঝে মাঝে আউশ ধান পচে নষ্ট হয়ে যেত। কারণ সময়টা ছিল বর্ষার শুরু । টানা বর্ষণের কারণে অনেক সময় রোদে শুকানো যেত না সেই আউশ ধান । তখন কৃষকরা চুলার মধ্যে কড়াইতে ভেজে ভেজে ধানগুলো কিছু নেওয়ার চেষ্টা করতো।
এদিকে বর্ষায় শুরু হতো পাটকাটা। পাট কেটে বিলের মধ্যে বেশি পানিতে নিয়ে পাট গুলো ডুবিয়ে রাখা হতো পচার জন্য। আউশ ধান এবং পাটের পর্ব শেষ হলে আবার মাঠের জমিগুলো তৈরি করা হতো আমন ধান রোপনের জন্য।
আমন ধানের ছিল বড় রূপ বৈচিত্র। কি সুন্দর নাম ছিল বিভিন্ন ধরনের আমন ধানের। বাশীরাজ , কাইশ্যা বিন্নী, বনকোষ, হরি রাজ, আরো কত ধানের নাম ছিল আমার এখন মনে পড়ছে না। প্রত্যেকটি ধান থেকে যে চাল হত সেগুলার ছিল অনেক রূপ বৈচিত্র। এক এক ধরনের ধানের চালের স্বাদ ছিল এক এক রকম।
চাষ হতো চমৎকার একটি ধান। নাম ছিল তুলসী মালা। কি সেই সুঘ্রাণ। ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে, তখনই মনে হতো যেন পোলাও রান্না হচ্ছে। এ ধরনের আরেকটি অ্যারোমেটিক রাইস ছিল কালোজিরা।
অবস্থাপন্ন কৃষকেরা বিভিন্ন ধরনের ধান আলাদা আলাদা ডুলাতে সংরক্ষণ করে রাখত। সেই ধানগুলো ঢেঁকিতে ছেঁটে চাউল করে মটকায় রেখে আগামী এক বছর তারা এই ঘরের চাল দিয়েই চলতো। শুধু কিছু চাল বিক্রি করে তখন কেরসিন এবং লবণ কিনে আনতো। কৃষকের জীবন যাপনে আর তেমন একটা কিছু কিনতে হতো না।
শুধু যেদিন পাট বিক্রি করা হতো সেদিন দেখতাম মায়েদের জন্য শাড়ি , ছেলেদের জন্য লুঙ্গি পাঞ্জাবি এগুলো কেনা হতো। অনেকটা উৎসবের মতো ছিল সেই সময়টা। পাট বিক্রি করে ইলিশ মাছ নিয়ে আসা হতো এবং কচু দিয়ে সেগুলো রান্না করে মজা করে খাওয়া হতো সেই বর্ষাকালে।
বর্ষার শেষে প্রকৃতি ভিন্ন রূপ ধারণ করত। মাঠের জমিগুলো থেকে পানি আস্তে আস্তে সরে যেত। এই সময়টাতে মূলত কোন কৃষি কাজ ছিল না। ওই সময়ে কৃষকদের খুবই অলস সময় কাটতো। শিকারিরা পাখি শিকার করতো, বাকিরা ঘর দুয়ার ঠিক করার জন্য সারা বছরের রশি পাকাতো টার্কি দিয়ে। বাঁশ কেটে চাটাই তৈরি করতো। ডুলা তৈরি করত আমন ধান সংগ্রহ করার জন্য। তবে বর্ষার শেষে শরতের আগমনের ওই সময়টাতে প্রচুর মাছ ধরা পড়তো। কৃষকরা তখন মাছ ধরা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।
হেমন্তকালটা ছিল বাংলার পল্লী প্রকৃতির অপরূপ এক সুন্দর দৃশ্য। সোনালী পাকা ধানে মাঠ ভরে যেত। মাঠের পর মাঠ মনে হয় হতো সোনালী চাদর বিছিয়ে রাখা হয়েছে। নতুন ধানে কৃষকের গোলা ভরে যেত । গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দের সীমা ছিল না। বিভিন্ন জায়গায় মেলা আয়োজন করা হতো। সেখানে বিভিন্ন ধরনের বাঁশ কাঠের তৈরি আসবাবপত্র বিক্রি করা হতো। কৃষকের তখন টাকা পয়সার অভাব থাকতো না। ফলে গ্রামে গঞ্জে বেচাকেনাও খুব ভালো হতো।
সাধারণত এই সময়টাতেই বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠান, ওয়াজ মাহফিল, বিয়ে-শাদী এগুলো খুব জমতো। কারণ কারো হাতে তখন টাকা-পয়সার অভাব থাকতো না।
এই যে সারা বছর ব্যাপী কৃষিকাজ হতো, কৃষি পণ্য উৎপাদন হতো, সবকিছুতেই ছিল প্রকৃতির ছোঁয়া। গ্রামগঞ্জের মানুষ তাজা শাকসবজি ফলমূল এবং প্রাকৃতিক উপায়ে চাষবাস করে যে খাবার উৎপন্ন করতো, সেগুলো খেয়ে তারা দীর্ঘজীবী হতো। মানুষ তখন নিত্য দিনের রোগ যন্ত্রণায় ভোগত না। ফলে তাদের নিত্যদিন ড্রাগ কেমিক্যাল ট্যাবলেট খাওয়া দরকার হতো না।
1 Comments
অনেক কিছু জানলাম
ReplyDelete