গ্রামীণ জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, জিনিসপত্র কেমন ছিল ?

 গ্রামীন জীবন ধারণ পদ্ধতি ষাট - সত্তর দশকের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। গ্রামীণ জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি,  জিনিসপত্র অথবা বিলুপ্ত হওয়া জিনিসপত্র এগুলো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কল্পনা।

গ্রামীণ জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি,  জিনিসপত্র কেমন ছিল ?


 প্রথমে আসা যাক গ্রামীণ কুঁড়েঘর । খুবই আরামদায়ক একটি ঘর। মাটির ভিটি করা এ ধরনের ঘর একেবারেই এসির মত আরামদায়ক ছিল। যদিও গ্রামে গঞ্জে এখন আর এ ধরনের কুঁড়েঘর চোখে পড়ে না। সব বাড়ির ঘর এখন পাকা হয়ে গেছে। গ্রামের ছোট ছোট রাস্তাগুলোও এখন পাকা। প্রত্যেক বাড়িতেই ইলেকট্রিসিটি । শহরের মতো আধুনিক জীবনযাপন ব্যবস্থা।

কথা হল ষাট অথবা সত্তুর এর দশকে এদেশের গ্রামীণ জীবন কেমন ছিল,  তাদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির অথবা জিনিসপত্র কেমন ছিল?

যেমন ধরুন মাছ ধরার জন্য গ্রামের মানুষ কি ব্যবহার করত চলুন দেখা যাক।

টাকজাল:

বর্ষার দিনে মাছ ধরার জন্য টাকজাল খুবই জনপ্রিয় ছিল। বাড়ির আশেপাশের খাল বিলে এই ফেলে কৃষকরা বসে থাকতো।জলের ধার দিয়ে দলবেঁধে ছোট ছোট মাছ যখন যেত তারা তখন এটিকে টেনে উঠিয়ে আনত। আড়া আড়ি দুটি কঞ্চি বেঁধে চারকোনা হতো। জালটি চার কোনায় লাগিয়ে ওটার উপরে একটা বাঁশের কুড় লাগিয়ে এটিকে ব্যবহার করা হতো।



ঝাকি জাল:

গোল মত একটি জাল। যার নিচের দিকে ভারী লোহার কবজ লাগিয়ে নেওয়া হয়, যাতে নিক্ষেপ করলে একদম পানির মধ্যে নিচে মাটিতে গিয়ে বসে যায়। ফলে ওই জায়গার মাছগুলো জালের ভিতরে আটকা পড়ে। কৃষকরা তখন জাল টেনে টেনে ডাঙ্গায় তুলে নিয়ে মাছগুলো ধরে ফেলে।



কই জাল:

সাধারণত কই,  টাকি,  এমনকি শিং মাগুর মাছও এই জালে আটকা পড়ে। এটি অনেকটা বাগানে বেড়া দেওয়ার মতো জাল। মোটামুটি দুই থেকে আড়াই ফিট উচ্চতার এই জালটি হয়ে থাকে লম্বায় ২০-৩০ ফুট। এটি সাধারণত বিলের কিনারায় ঘেঁষে অথবা ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে অথবা অগভীর জলে দুই পাশে খুঁটি বসিয়ে টানা দিয়ে রাখা হয়। কই, টাকি, পুঁটি ইত্যাদি ছোট মাছের জন্যই এই জালটি পাতা হয়।



ক্ষেওজাল:

এটি একটি তিনকোনা জাল। সাধারণত কচুরিপানার নিচে ক্ষেও দিয়ে শিং,  টাকি,  সোল, গজার এগুলা এই জাল দিয়ে ধরা হয়। তিনটি চিকন বাঁশ দিয়ে একটি ফর্মা তৈরি করা হয় এবং সেই কর্ম অনুযায়ী জালটি বেঁধে দেওয়া হয় একটা বাঁশ একটু লম্বা রাখা হয় ধরার জন্য। ওই বাড়তি অংশটি জালের হাতল হিসেবে কাজ করে।



খালোই:

এটি বাঁশের চিকন চিকন বেত দিয়ে বুনা ছোট একটি ডুলার মত পাত্র যেটাতে মাছ ধরে রাখা হয়। দেশের বিভিন্ন জেলায় এটির আঞ্চলিক নাম থাকতে পারে। তবে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় এটাকে বলা হয় খালই



উইন্যা বা চাই:

মাছ ধরার চমৎকার একটি ফাঁদ। এটাতে মাছ ঢোকার ব্যবস্থা আছে কিন্তু বের হওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। পানির নিচে অথবা অর্ধ পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। নির্দিষ্ট সময় পরপর এটি উঠানো হয়।



বাইর:

এটিও চাই বা উইন্যার মত একটি জিনিস। তবে এটি দেখতে গোল এবং লম্বা। এটির ভিতরেও মাছ প্রবেশ করতে পারে কিন্তু বের হতে পারে না। পানির নিচে ডুবিয়ে রাখা হয় অথবা যেদিকে পানির স্রোত আছে সেখানে বসিয়ে দুই পাশে আটকে দেওয়া হয় যাতে মাছগুলো স্রোতের সাথে এর ভিতরে প্রবেশ করতে পারে।



বের জাল:

বিশাল বড় জাল। জলাশয়ের অনেক দূর থেকে এটি দিয়ে বের দেওয়া হয়। নিচের অংশ ভারী ইটা জাতীয় জিনিস আটকে দেওয়া হয়। উপরের অংশে বেলুন টাইপের জিনিস সেট করে দেওয়া হয় যাতে ভেসে থাকে। এরপর একসাথে টেনে আনা হয় এবং এর ভিতরে যত মাছ আছে সব উঠে আসে।



পলো:

এটি দেখতে খুবই সুন্দর একটি যন্ত্র। এক পাশে চিকন মাথা অপরদিকে বিশাল বড়। মাছ  শিকারীরা চিকন মাথায় ধরে পানিতে চেপে চেপে মাছ ধরে।



কুচ:

একটি বাশের লম্বা হাতল দিয়ে তৈরি করা হয়। এক মাথায় কতগুলো লোহার ধাড়ালো শিক বেঁধে দেওয়া হয়। যখন স্বচ্ছ পানি দিয়ে মাছ ভেসে যায় তখন শিকারি ঘা দিয়ে মাছটিকে আটকে ফেলে।



কৃষি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে,

কাঁচি বা কাস্তে:

এটি দিয়ে সাধারণত ধান কাটা হয়। গরুর খাবারের জন্য মাঠ থেকে ঘাস কাটার জন্যও এ যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়।



দাও:

এটি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। যেমন পাট ক্ষেতের পাট কাটার জন্য এক ধরনের দাও ব্যবহার করা হয় যেটি চিকন এবং লম্বা।

আবার বাঁশ কাটার জন্য যে দাও ব্যবহার করা হয় সেটি অনেকটাই মোটা এবং ভারী।



ছেনি:

এটি পাট ক্ষেত অথবা ধান ক্ষেতের ঘাস বাঁছার জন্য এই ছোট্ট লোহার যন্ত্রটি ব্যবহার করা হতো। একপাশে কাঠের হাতল লাগানো অন্য দিকের অংশটা মাটি খোঁচানোর জন্য একটু ধারালো থাকতো।



খুন্তি:

লম্বা বাশের আছাড়ি যুক্ত একটি যন্ত্র যার এক পাশে লোহার পাতের মতো একটি ধারালো অংশ লাগানো থাকে। এটি দিয়ে সাধারণত মাটিতে গর্ত করা হয়।



মুগুর:

এটি লম্বা হাতল যুক্ত । এক মাথায় ভারী কাঠ লাগানো থাকে। এটি দিয়ে পিটিয়ে মাটিতে খোটা বসানো হয়। শুষ্ক মৌসুমে চাষ করা ক্ষেতের বড় বড় ইটা গুলা এটি দিয়ে পিটিয়ে ভাঙ্গা হয়।



বিন্ধা:

একটি লম্বা কাঠের মধ্যে চিরুনির মতো শলাকা লাগানো থাকে। লম্বা একটি হাতল দিয়ে এটিকে গরু দিয়ে মাঠে টেনে নেওয়া হয়। সাধারণত: জমিতে বেশি ঘাস হলে এই যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়।



মই:

দুই পাশে দুইটি বাঁকা চ্যাপ্টা বাঁশ লাগিয়ে মাঝে মাঝে খিলান দিয়ে একটি যন্ত্র বানানো হয়। এটি গরু দিয়ে টেনে জমিকে সমতল করা হয়।



চঙ:

এটিও মই এর মত একটি যন্ত্র। তবে এর দুই পাশের চ্যাপ্টা বাঁশ বাঁকা হয় না বরং সোজা হয়। সাধারণত গাছে চড়া, ঘরের চালে উঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই চঙ ব্যবহার করা হয়।





উড়ি:

বোরো ধানের সিজনে বোর ক্ষেতে পানি দেওয়ার জন্য উড়ি দিয়ে পানি সেচ করা হয়। এটি একটি তিনকোনা বাঁশের টুকরি। একপাশে দুটি এবং অন্যপাশে দুটি রশি লাগিয়ে দুই পাশে দুইজন ব্যাক্তি টেনে টেনে সেচ করে থাকে।



বাউক বা ভার:

এটি এক ফালি বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়। এর দুই পাশে রশি দিয়ে দুটি টুকরি লাগিয়ে এর মধ্যে জিনিসপত্র নিয়ে কাঁধে করে বহন করা হয়। তাছাড়া মাঠের ধান কেটে এই বাউকের দুই পাশে ধানের আঁটি ঝুলি কাঁধে করে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।





মাতলা বা পাতলা

কৃষকেরা দুই হাতে কাজ করতে হয় বিধায় এক হাতে ছাতা ধরে কাজ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে তারা বাঁশ থেকে পাতলা বেত তৈরি করে সেই বেতের সুন্দর গাঁথুনি দিয়ে মাথায় বসে থাকে এরকম মাতলা তৈরি করে। এটির দুটি অংশ থাকে প্রথম অংশর উপর এক ধরনের গাছের পাতা বসিয়ে তার উপরে আরেকটি অংশ স্থাপন করে এই মাতলাটি তৈরি করা হয়। এটি মাথায় দিয়ে কৃষকরা রোদ বৃষ্টিতে অনায়াসে কাজ করতে পারে।




টাহৈড়:

এটি কাঠের একটি গোল চাকার ভিতরে ছিদ্র করে মাঝখানে একটি বাঁশের শলাকা ঢুকিয়ে তৈরি করা হয়। পাটের আঁশ এর মাথায় লাগিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লম্বা রশি তৈরি করা হয়।

এছাড়া গৃহস্থ বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র দেখা যেত।



শিকা:

পাটের রশি জোড়া দিয়ে দিয়ে সুন্দর ডিজাইনের শিকা বুনত আগের দিনের মেয়েরা। ঘরের বেড়ার পাশ দিয়ে এগুলো ঝুলিয়ে রাখা হতো। এর মধ্যে সাধারণত মাটির কলস অথবা নকশা করা মাটির পাত্র রাখা হতো। এই পাত্রগুলোই ছিল গ্রামীণ মানুষের বিভিন্ন ধরনের অলংকারাদি সংরক্ষণ করা অথবা টাকা পয়সা সংরক্ষণ করার মাধ্যম।



গাইঞ্জা:

চারটি বাঁশের  কাঠামোর মধ্যে পাটের রশি দিয়ে একটি ঝুলন্ত বাস্কেটের মতো তৈরি করা হতো । এটির মধ্যে ব্যবহৃত কাপড় চোপড় সব ঠেসে রেখে দেওয়া হতো।



আইল‌্যা:

শীতকালে বাড়ির বয়স্ক লোকদের শরীর বেশি ঠান্ডা হয়ে যায় । তাদের হাত-পা গরম রাখার জন্য এই ব্যবস্থাটি করা হয় । ঘরের এক কোণে একটা মাটির পাতিল মাটিতে পুতে ধানের তুষ দিয়ে সন্ধ্যা বেলায় আগুন ধরিয়ে রাখা হয়। এটি সারারাত জ্বলতে থাকে এবং তাপ উৎপন্ন করতে থাকে। বয়স্করা সেখান থেকে প্রয়োজনীয় তাপ নিয়ে হাত-পা গরম করে নিতে পারে।



হুক্কা বা ডাবা:

 নারিকেলের খোলের মধ্যে একটি কাঠের নইচা বসিয়ে ডাবা বা হুক্কা তৈরি করা হতো। নইচার মাথায় মাটির কলকি বসিয়ে ওর মধ্যে তামাক দিয়ে গৃহস্থরা হুক্কা টানতো।



ফরসি হুক্কা:

পিতল বা দস্তা দিয়ে একটি বাটির মতো তৈরি করে তার উপর কাঠের নইচা বসিয়ে এটি তৈরি করা হতো। নইচার মাথায় মাটির কল্কি বসিয়ে তার মধ্যে তামাক এবং আগুন দিয়ে অবস্থাপন্ন কৃষকেরা মনের সুখে হুক্কা টানতো। তবে এক্ষেত্রে নিচের বাটির অংশে একটি রাবারের নল দিয়ে হুক্কা টানার ব্যবস্থা করা হতো। এটি আগেকার জমিদার এবং অবস্থাপন্ন কৃষকেরা ব্যবহার করতো।



পানের সাজি:

এখনো গ্রামে গঞ্জে বাশের চটি এবং সূতা দিয়ে চারকোনা বক্সের মত একটি জিনিস তৈরি করা হয় যার মধ্যে পান সুপারি জর্দা ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা হয়। এছাড়া আরো পিতলের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পানপাত্র আগের দিনে ব্যবহার করতে দেখা যেত।



ডোলা:

বাঁশ থেকে পাতলা করে বেত তৈরি করে সেই বেতের গাথুনি দিয়ে চমৎকার ডোলা তৈরি করা হয়। কৃষকরা সারা বছরের ধান-চাল সংরক্ষণ করার জন্য এই ডোলা ব্যবহার করে থাকে।

কালের বিবর্তনে গ্রামীণ জিনিসপত্র অনেক কিছুই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমার শৈশবে যে সমস্ত জিনিসগুলো নজরে এসেছিল, সেগুলো যতটুকু আমার মনে পড়েছে আগামী প্রজন্মের জন্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।









Post a Comment

0 Comments