কেমন ছিল ষাটের দশকে বাংলার প্রকৃতি ?

আবহমান বাংলার প্রকৃতি বাংলার মানুষের মন-মানসিকতা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিনির্মাণ করেছে যুগ যুগ ধরে।


কেমন ছিল ষাটের দশকে বাংলার প্রকৃতি ?

গ্রামের পরিবেশ:

আমাদের বাড়িটা ছিল একেবারে অজপাড়া গায়ে। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছিল একটি খাল। বর্ষাকালে গ্রামের আশেপাশে যত জমি ছিল সব ছিল পাট ক্ষেত আর পাট ক্ষেত । গ্রামকে তখন গ্রাম মনে হতো না। মনে হতো যেন একটি পাটের বন। কৃষকরা পাট কেটে এই খালের মধ্য দিয়ে পাশের বিলে নিয়ে যেত ডুবিয়ে রাখার জন্য। পাট পচে গেলে দূর থেকে নৌকায় করে এই খাল দিয়ে আবার গ্রামের ভিতরে নিয়ে আসা হতো। কি সেই প্রাণের জোয়ার ছিল। ছেলে বুড়ো সবাই মিলে পচা পাটের গন্ধ নিয়েই এই পাট খালাস করা হতো। গ্রামের পথে-ঘাটে সোনালী পাট গুলো রোদে শুকানো হতো। পাট কাঠি গুলো আঁটি বেঁধে ছড়িয়ে দেওয়া হতো গোল চক্করের মতো। সে এক অপরূপ দৃশ্য। বাস্তব চোখে না দেখলে তার সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায় না।

গ্রামের বাড়ি তখন ছিল খুবই সুন্দর । সামনে পিছনে নারিকেল গাছ বেষ্টিত পুকুরগুলো ছিল অপরূপ সৌন্দর্য ময়। ষড়্ঋতুর এই দেশের রূপবৈচিত্র তখন প্রত্যক্ষ করা যেত নিবিড় ভাবে। মনে  পরে বর্ষার কথা। বিরতিহীন বর্ষা চলছিল সাত আট দিন ধরে । টানা বৃষ্টিতে গ্রামের খাল বিল পাশের ক্ষেতগুলো উপচিয়ে বৃষ্টির পানি উঠানগুলো ছাপিয়ে গিয়েছিল।

ঝড়ের রাত:




সবচেয়ে মজা হতো ঝড়ের রাত্রিতে। টানা বৃষ্টির সাথে শুরু হয়েছিল ঝড়। তখনো আমাদের বাড়িতে রেডিও আসেনি। নিম্নচাপ কি, মহা বিপদ সংকেত কি? আমরা কিছুই জানতাম না। মনে হচ্ছিল আমাদের বাড়িঘর সব উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সারারাত ঝড় হয়েছিল । সকালবেলা ঘর থেকে নামার কোন যোগাড় ছিল না । কারণ আশেপাশের সব গাছপালা ভেঙে একাকার হয়ে মাটিতে পড়েছিল। বাড়ির উঠানটাকে মনে হচ্ছিল একটি নদী । সেখানে শোল-গজার বোয়াল মাছের আনাগোনা দেখে বড়ই আনন্দ পেয়েছিলাম। ঘরের দরজায় বসে উঠানে মাছ ধরার ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা। উঠানে পরে থাকা চাই গুলোর ভিতরে ধরা পড়ল বড় বড় বাইন ও বেলে মাছ। গ্রামের মধ্যে তৈরি হয়েছিল এক ভুতুড়ে পরিবেশ। ছোট ছোট ঘর গুলো চাল উড়িয়ে নিয়েছিল। গ্রামের কোন গাছপালা অক্ষত ছিল না। পরবর্তী দুই-তিন মাস গ্রামের মানুষের কি দুর্দশা হয়েছিল , সেই বিবরণ এখানে আর দিলাম না।

স্কুলে যাওয়া:




গ্রামের বাড়িঘর গুলো বর্ষাকালে মনে হতো এক একটি দ্বীপের মত। গঞ্জে যাওয়ার কোন রাস্তাঘাট ছিল না। গ্রামের ধান ক্ষেতের আল গুলোই ছিল একমাত্র রাস্তা।
আমাদের একমাত্র স্কুল সেদিনকার ঝড়ে উড়িয়ে নিয়েছিল। পাড়ার ছেলেরা গ্রামের ক্ষেতগুলো দিয়ে হাঁটু পানি,  কোমর পানি মাড়িয়ে স্কুলে যেতাম। প্রায়দিন ই বই খাতা নিয়ে পানিতে পড়ে যেতাম । সেদিন আর স্কুলে যাওয়া হতো না। বইখাতা রোদে শুকিয়ে দিন পার করতাম। যেদিন স্কুলে যাওয়া হতো, আমতলা জামতলায় বসে পড়াশোনা করতাম। সব ছেলে মেয়েরা সমস্বরে নামতা শিখতাম। কত আনন্দের ছিল সেই দিনগুলো।

নৌকা ভ্রমণ:




সেটা ছিল সম্ভবত শরৎকাল। বর্ষার শেষে প্রকৃতি এক ভিন্ন রূপ ধারণ করেছিল। বাড়ির ধারে  বিলের পানি কমে এসেছিল। নৌকা দিয়ে দাদী যাচ্ছিলেন বাপের বাড়ি। যখন নৌকা আমাদেরকে নিয়ে খালের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল , নৌকার দুই পাশে ভেসে থাকা মাছগুলো হাতে ছুঁয়ে দিচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে এত ঘন কচুরিপানা ছিল,  মনে হচ্ছিল সবুজ কার্পেটের ভেতর দিয়ে একটি রাস্তা তৈরি করা। আমাদের নৌকাটি এগিয়ে যাচ্ছিল,  তিন চারটি খাল পেরিয়ে আমরা যখন বিশাল কেইলা বিলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম, প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করে সেদিন মুগ্ধ হয়ে ছিলাম । মনে হয়েছিল শাপলা পদ্মফুলের বিছানা পেতে রাখা হয়েছে। দুই পাশে সহস্ত্র অজানা পাখিগুলো কলরব করছিল। প্রকৃতি যেন সেদিন নতুন সাজে আমাদের জন্য প্রস্তুত ছিল। দেখেছিলাম নলখাগড়ার বাগান যার কোন শেষ নেই। হঠাৎ করে আমাদের নৌকা এমন একটি জায়গায় চলে আসলো মাঝি তখন নবী রাসুলের নাম জপে নৌকা চালাচ্ছিল সীমাহীন কালো জলরাশি দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। পড়ন্ত বিকেলে দিগন্ত রেখার মধ্যেও দূরের গ্রামগুলো দেখা যাচ্ছিল না। ভয় আনন্দ দুটোই কাজ করছিল। এই বিশাল জলরাশির মধ্যে সূর্যাস্তের দৃশ্য অবলোকন করতে করতে  সূর্যাস্তের কাছাকাছি সময় দাদির বাপের বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়েছিল। পাড়ার ছেলে মেয়ে আত্মীয়-স্বজন ভিড় করেছিল আমাদেরকে স্বাগত জানাতে। অনেকেই দাদিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছিল এই বলে, কতদিন পরে দেখা। সেই স্মৃতি আজও ভুলতে পারিনি।



পালকিতে নানার বাড়ি:




 যখন একেবারে ছোট ছিলাম তখন মনে পড়ে নানা ৮ বেহারার পালকি পাঠিয়ে দিত। মা আমাদেরকে পালকিতে নিয়ে নানার বাড়ি যেতেন।
বেহারাদেরকে  চাল, ডাল ,তরকারি , মাছ সব দিয়ে দেওয়া হতো। ওরা ইচ্ছামত রান্না করে খেত। ওদের যে খাওয়া ছিল , সেই কলাপাতা বিছিয়ে ওরা এক একজন কেজি পরিমাণ চালের ভাত খেয়ে ফেলতো।
দুপুরের খানা খেয়ে ওরা মাকে নিয়ে রওনা হতো। সেই শুকনা বন বাদার পেরিয়ে বেহারারা এগিয়ে যেত। সাধারণত ফাল্গুন চৈত্র মাসে এই বেহারা যাত্রা হত। দূরগ্রামের চারদিকে শিমুল ফুল ফুটে প্রকৃতি লাল হয়ে থাকতো। আহা সে কি অপরাধ দৃশ্য ছিল। বেহারাদের শ্লোকের তালে তালে পালকি বয়ে নেওয়ার সেই স্মৃতির আজও মনে পড়ে,:
মাইয়া যারে বাপের বাড়ি, খাইবো আজি নারী-ভরি,
হাহ হা, হোহ হো।।
কয়েক বছরের মধ্যেই দেশ থেকে পালকি উঠে গিয়েছিল।

গরুর গাড়ি:


ছোটবেলার আরেক রোমাঞ্চকর স্মৃতি মায়ের সাথে গরুর গাড়িতে নানার বাড়ি ভ্রমণ।তখন নানা মাকে নাইওর নেওয়ার জন্য গরুর গাড়ি পাঠাতেন। গরুর গাড়িতে নৌকার মতো ছৈ লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ঘিরে মাকে নিয়ে গাড়োয়ান রওনা হতো। কোন রাস্তা ছিল না গ্রামের মাঠে আরো গাড়ি যেতে যেতে লিক হয়ে গিয়েছিল। সেই পথ ধরে গাড়ি চলতো কেরাত কে কু কি শব্দ করে করে গাড়ি এগিয়ে যেত। খানিক পরে পরেই উঁচু টিলায় উঠতো আর আমাদেরকে বলতো শক্ত করে ধরো। আমরা ছোট ছোট পিচ্চিরা  হইহুল্লা করতাম। 
মাঝে মাঝে অনেক উঁচু জমিতে উঠতে হতো তখন গরুগুলো টানতে পারতো না । উচু জমি থেকে নামার সময় গাড়ি খুব দ্রুত নেমে যেতো আর আমরা খুব আনন্দ উপভোগ করতাম। ঘন্টা দুয়েক এভাবে চলতে চলতে গাড়ি চলে আসতো সদর রাস্তার দিকে। শান বাঁধানো  লাল সড়ক শুধু লাল ধুলাবালি। অপরূপ সুন্দর ছিল। মাঝে মাঝে দু-একটা ট্রাক্টর চলতে দেখতাম নানার বাড়ির রাস্তা এই লাল সড়ক পাড়ি দিয়ে যেতে হতো। নিচু জমি থেকে উঁচু লাল সড়কে উঠা ছিল অনেক কষ্টসাধ্য। 
আমাদের কে নামিয়ে দিয়ে অতি কষ্টে লাল সড়কে আরোহন করত। এরপরে গাড়ি সবাইকে নিয়ে আবার নিচে জমিতে যখন নামতো সেই সময়টাই ছিল সবচেয়ে রোমাঞ্চকর। মনে হতো গাড়ি সব উল্টিয়ে পড়ছে,  আর আমরা হইহুল্লা করতাম। ততক্ষণে গাড়োয়ান আবারো নিচু জমি দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেত। দূর থেকে গঞ্জের হারিকেন বাতিগুলো দেখা যেত। রাত নয় - দশটার দিকে গাড়ি নানার বাড়িতে পৌঁছাত। 
ততক্ষণে কালো ইঞ্জিন ধোঁয়া ছেড়ে মোহনগঞ্জের গাড়িটা গঞ্জে এসে পৌঁছাত। জেলেরা ওই গাড়িতে করে বড় বড় মাছ নিয়ে আসতো। নানা সেই রাতে মাছ কিনে আনতেন ।সেই রাতেই নানি মাছ রান্না করে সবাইকে খাওয়াতেন। ছিল একটা উৎসবের মতো আনন্দ।

আজ সেই গ্রামীন জীবন হারিয়ে গিয়েছে। নতুন প্রজন্মের কাছে হয়তো এই এই জীবনের কোন মূল্য নেই। কিন্তু তখনকার সময়ের মানুষের কাছে সেই জীবন ছিল বড়ই উপভোগ্য প্রকৃতির কোলে বসবাস করার মত একটি জীবন।

Post a Comment

0 Comments